বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে আমার দ্বিতীয় নিবন্ধ। জানি, কোন সভ্য পরিশীলিত ভাষায় ঘটমান পৈশাচিক উন্মাদনাকে বর্ণনা করা যায় না তবু্ও নিজের ভেতরের যন্ত্রণাকে কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। মনে হয় আরও জোরে চিৎকার করে এই নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আমার আশেপাশের অতি বুদ্ধিজীবী এবং অতি বিপ্লবী যারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে বিপ্লবের সংকেত পেয়েছেন তাদের তথাকথিত প্রজ্ঞা, মেধা ও সংবেদনশীলহীনতাকে চুড়ান্ত ঘৃণা জানিয়ে এই লেখায় আরও অনেক কথাই বলার ছিল। আমি সেই অতি প্রগতিশীল দলের লোক নই যারা মুসলমান মৌলবাদ নিয়ে নীরব থেকে হিন্দুত্বকে কাঠগড়ায় তোলে। আমার কাছে হিন্দু মৌলবাদ ও মুসলমান মৌলবাদ সম দোষে দোষী। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নেমে আসা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমার শানিত কলম যেন অবিরত লিখে যেতে পারে।
বাংলাদেশের আজকের বার্তালিপি পত্রিকায় প্রকাশিত
বাংলাদেশ অতঃপর
দীপক সেনগুপ্ত
বাংলাদেশ অন্য আর পাঁচটা প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আলাদা অন্তত আমার মত অনেকের কাছে কেননা আমাদের অনেকেরই শিকড় প্রোথিত রয়েছে সেই রাষ্ট্রে। বাংলাদেশকে নিয়ে তাই আমাদের ভালোবাসা, উদ্বেগ এবং আবেগ ভিন্নমাত্রিক। রাতারাতি রাষ্ট্রীয় সত্তা বদলে যেতে পারে , যেমন বদলে গেছিল ৪৭ সালের ১৪ আগস্টের মাঝরাতে কিন্তু জাতীয়তাবাদ যা শত সহস্র বছরের সংমিশ্রণে তৈরি হয় তা কোন রেডক্লিফ লাইনের বিভাজনে নষ্ট হয় না। সেদিক থেকে এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে এক বৃহত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সব বাঙালিরা । যে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করলাম সেটা এক অর্জন এবং অবশ্যই ঐকান্তিক সাধনার ফল।
খণ্ডিত স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে সাত দশকের অধিক সময় অতিক্রম করেও আমরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নামের সঙ্গে ‘পশ্চিম’ জুড়ে রেখেছি আর বরাক উপত্যকার প্রান্তিক সীমায় বসে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য বাংলার তৃতীয় ভূবন রচনা করে একই সূত্রে ভিন্ন মানচিত্রের সব বাংলাকে গ্রন্থিত করেছেন । ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের উত্থাল ঢেউ আমাদের মনে ঝড়ের জন্ম দিবে এটাই স্বাভাবিক। ঘন্টার পর ঘন্টা টিভির সামনে বসেছিলাম বিমূঢ় বিষ্ময়ে স্তব্ধবাক হয়ে। এটি একটি কুনাট্যের যবনিকা পতন। যবনিকা পতন না অবক্ষয়ের সূচনা? সময় উত্তর দিবে এই প্রশ্নের। তবে যে বিকৃত এবং বিকারগ্রস্ত ক্ল্যাইমেক্সের দৃশ্যের নির্মাণ দেখা গেল তাতে অশ্রুসিক্ত এবং শিহরিত হলাম। আনন্দে উদ্বেলিত অশ্রুতে নয় দুঃখে ও বেদনায় এবং উত্তেজনার শিহরণে নয় ভয়ের শিহরণে মুর্ছা গেলাম।
জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ বইয়ে আমরা দেখেছি একটা আন্দোলনকে কতটা সুচারু এবং সুনিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে গিয়ে একটা নতুন যুগের সূচনা করা যায় কিন্তু বাংলাদেশে গত ৩৬ দিনের পর্বান্তরে দেখা গেল আন্দোলন কতটা নিয়ন্ত্রণহীন হলে এভাবে লুঠ এবং সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। শিবদাস ঘোষের কথা মনে হল তিনি বলেছিলেন ‘রাজনীতি একটি উচ্চ হৃদয় বৃত্তি আর বিপ্লবী রাজনীতি একটি উচ্চতর হৃদয় বৃত্তি’। ৫ আগস্টের বাংলাদেশে আর যাই হোক কোন বিপ্লবী চেতনা ছিল না যা ছিল এক বীভৎস উন্মাদনা যে উন্মাদনায় রিপুর দবদবানি ছাড়া সুক্ষ্ম চেতনার ছিটেফোঁটা ছিল না। এই উন্মাদনায় বিজয়ের আনন্দের মহত্বকে খুঁজতে যাওয়া মুর্খামী ছাড়া আর কিছু নয়। মুন্না মজুমদারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিলচরের নাহাটা টেক্সটাইলে লুটের ঘটনা বা ১৯৭৮ সালের মিজো গণ্ডগোলের সময় মিজোদের বাসা লুটের ঘটনাকে মনে করিয়ে দিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যে উন্মাদনার বিকৃত উল্লাস দেখা গেল তাতে কোন উচ্চ হৃদয়বৃত্তির সন্ধানের প্রশ্নই উঠে না।
যে ছেলেটি বঙ্গবন্ধুর মূর্তির উপরে উঠে হাতুড়ি মারছিল সে আর যেই হোক ইতিহাসের ছাত্র নয় এটা নিশ্চিত। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই জানে এভাবে ইতিহাসকে মুছা যায় না । নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ায় লেনিনের মূর্তি ভেঙে মানুষের মন থেকে লেনিনকে মুছা যায়নি। আমার অতি পরিচিত উগ্র বামপন্থী ফেসবুক বন্ধু এতে জন হেনরির হাতুড়ি দেখেই উদ্বেলিত আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যাদের সব থেকে বেশি পড়া উচিত তারাই কিনা ইতিহাসের থেকে কোন শিক্ষা না নিয়ে এভাবে আনন্দে আত্মহারা হন। খুব বেশি পেছনে যেতে হবে না শ্রীলঙ্কা বা আফগানিস্থানে তো তথাকথিত গণ অভ্যুত্থান দেখেছি তাতে কার কী লাভ হয়েছে?
আন্দোলনের একটা নিজস্ব বিজ্ঞান আছে এবং সেই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে উন্মাদনায় মেতে উঠলে সত্যিকারের জয় আসেনা। অযথা রক্তক্ষয় হয় যেমন হয়েছিল ভারতের নকশাল আন্দোলনে। যে কোন আন্দোলনে পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের সুস্পষ্ট বিভাজন থাকা চাই। তারপর অক্ষ শক্তিকে চিহ্নিত করে মিত্রশক্তির জোট বাঁধা চাই। আন্দোলন হরি নাম সংকীর্তন নয় যে হাজার কন্ঠে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গাইলাম আর আন্দোলনটা প্রগতিশীল আন্দোলন হয়ে গেল। কে কোন ছদ্মবেশে , কে কোন মুখোশ মুখে দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। এত রক্ত বন্যা বইয়ে গেল তার বিচার যদিও হওয়া প্রয়োজন কিন্তু আদৌ হবে কিনা জানিনা।
কে কাকে মারল? কেনই বা মারল? কারা পুলিশ থানায় পুলিশকে মারল কেনই বা পাঁচতারা হোটেলে আবাসিকদের জ্বালিয়ে মারা হল? এক প্রাক্তন ছাত্র নেতার পরিবারের চারজনকে জ্বালিয়ে মারা হল, কেন? কেনই বা নিরস্ত্র আবু সাঈদের মত ছাত্রদের মরতে হল, কারা মেরেছিল? তারা কি সত্যিকার অর্থে পুলিশ ছিল? না পুলিশের পোষাক পরিহিত কোন প্রতিক্রিয়াশীল? অনেক অনেক নিরুত্তর প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সব রহস্যের জট। সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন কী ভাবে রাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলন হয়ে উঠলো এবং কী ভাবে সংবিধান সম্মত নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নৈরাজ্যকে আবাহন করা হল। এই আন্দোলন কি আদৌ ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল?
সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক পরিসরে বিরোধী স্বরকে চেপে দেওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। শাসক বিরোধী ভারসাম্যেই গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের পরিচয়। শেখ হাসিনা ইতিহাসের এই পাঠ জানতেন না, অনেকেই জানেন না। অনেককেই হুঙ্কার দিয়ে বিরোধী শূন্য গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখাতে দেখি আসলে তারা নিজেরাই দুঃস্বপ্ন দেখেন। সময়কে পরাভূত করতে গিয়ে সময়ের কাছেই তারা পরাভূত হন। এটাই ট্র্যাজেডি। প্ল্যাটোর ফিলোসোফার কিং হতে চান না কেউ । অমরত্বের আসনে বসতে গেলে হৃদয়কে জয় করতে হয় শুধু সিংহাসন জয়ই যথেষ্ট নয়। বঙ্গবন্ধু মুজিবের মূর্তি ভাঙায় অনেক মানুষ বিমর্ষ, কেননা তিনি মানুষের হৃদয়ে নিজের জায়গা করতে পেরেছিলেন যা তাঁর আত্মজা পারেননি। কার্যত একা পালিয়ে যেতে হল। নির্জনতায় নিসঙ্গতাকে অনুধাবন তারা করতে পারেন না কেননা সারাক্ষণ তারা স্তাবক পরিবৃত থাকেন। আর বিপদের সময় এই স্তাবকরাই সব চেয়ে আগে চম্পট দেয়।
বঙ্গবন্ধু কেবল হাসিনার বাবাই ছিলেন না তিনি জাতির জনক ছিলেন , তাঁর মূর্তি ভেঙে জাতির মেরুদন্ডকে ভাঙা হল। ভারতেও রাহুল গান্ধীর বিরোধীতা করতে গিয়ে রাজীব গান্ধীকে, ইন্দিরা গান্ধীকে এমনকি জহরলাল নেহেরুকে অস্বীকার করা হয়। জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, মুজিবর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিদের পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে তাঁদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে অস্বীকার করার মূঢ়তা একটা জাতির ইতিহাসকে অস্বীকার করার সামিল। ঐতিহ্য বিচ্যুত কোন আন্দোলন আধুনিকতাকে বরণ করে না, সেই আন্দোলনকে করে ছিন্নমূল।
বাংলাদেশের আন্দোলন সেই দিক থেকে ছিন্নমূল। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা ও গীতাঞ্জলি হাতে এগিয়ে যাওয়া মুক্তি যুদ্ধের বীর সেনানীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিপ্রতীপে যখন দেখা গেল পাঁচ আগস্ট তারিখে তথাকথিত জয়ের আনন্দে হিন্দুদের মন্দির এবং হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ করা হচ্ছে এবং ভারত বিরোধী স্লোগান দেওয়া হচ্ছে তখন আর বুঝতে অসুবিধে হয় না এই আন্দোলন ছাত্রদের সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন ছিল না এই আন্দোলন আসলে একটি চক্রান্ত ‘অ্যা গ্রেট কন্সপিরেসি’। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আর ভারতে মুসলমান বা শিখদের উপর অত্যাচার কাপুরুষতা ছাড়া কিছু নয়। যে কোন রাষ্ট্র সংখ্যা লঘু ব্যক্তিদের জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষা করতে প্রতিশ্রতিবদ্ধ থাকা উচিত। আওয়ামী লিগ সরকার হিন্দুদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে পারেনি বা দিতে চায়নি কেননা আওয়ামী লিগ শেষ পর্যন্ত জামাতিদের পর্যুদস্ত করলেও অন্য মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু তবুও বাইরে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা ছদ্মবেশ ছিল সেই ছদ্মবেশটুকু খুলে গিয়ে বাংলাদেশ এখন ‘দিগম্বর’।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যৌথ মঞ্চ সার্ক এখন কার্যত বিলুপ্ত। জি-এইট, জি-টুয়েন্টি ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মঞ্চের পাশাপাশি যদি এই আঞ্চলিক মঞ্চকে বাঁচিয়ে রাখা যেত আর যদি অন্ধ ভারত বিদ্বেষ , পাকিস্তান বিদ্বেষ ইত্যাদিকে দূরে রেখে পারস্পরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যেত যেমন করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের কনফেডারেশন তৈরি করে। কিন্তু কার্যত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষ কতটা আত্মঘাতী সেটা বোঝার ইচ্ছে বা ক্ষমতা বাংলাদেশে আন্দোলনকারীদের নেই তারা কলের পুতুলের মত মদতদাতাদের ইশারায় ভারত বিদ্বেষী স্লোগান দেয় , হিন্দুদের ঘর পোড়ায়।
বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন (অবনমন) আসার সম্ভাবনা আছে যেমন রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীতকে বদলে দেওয়া হবে আরও কতকিছু হতে পারে। এই দুর্ভাবনাকে মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি
“ দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে/
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে/
সবারে না যদি ডাকো,/
এখনো সরিয়া থাকো,/
আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান/
মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।‘’